কয়েকজন সাদা মানুষ (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৬)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:৫৩:৪২ সকাল
কফিল ডাইনিং টেবিলে সেই কখন খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওরা খেতে বসেনি।
এখনো রশীদ এসে পৌঁছেনি। হেলাল, খালিদ, রুনা আগে পিছে সুজনের বাসায় এসেছে। মোবাইলে আর ফেসবুকে ওদের ভিতর প্রতিদিনই যোগাযোগ থাকার পরও প্রত্যেকবারই প্রথম দেখাটা একটা আনন্দঘন মুহুর্তকে নিয়ে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
কিছুক্ষণ টিভি দেখে সময় কাটালো। গান শুনলো। এরপর পুরনো দিনের স্মৃতি কাতরতায় ভুগে আর কিছুই করার না পেয়ে সবাই চুপচাপ বসে রইলো। রুনা রশিদের দেরী দেখে কিছুটা উৎকণ্ঠায় ভোগে। এই বন্ধুটার জন্য ওর হৃদয়ে এক আলাদা টান। তবে সেটাকে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই। অন্তত এই বয়সে। খালিদ খুব রেগে গেলো। বললো, ‘ এই মফিজ্যা একটা মোবাইল অন্তত রাখতে পারে না?
সুজন হাসে। হেলাল কিছু বলে না। রুনা রশীদের পক্ষ নিয়ে উত্তর দেয়, ‘ ওর স্বভাব তো এমনই।‘ খালিদ শুধু রুনার দিকে এক পলক তাকায়। কি ভেবে আর কথা বাড়ায় না।
সুজন আগামীকাল বাগেরহাট যাবার বাসের টিকেট করে এনেছে কিনা কফিলকে জিজ্ঞেস করে। কফিল ৫টি টিকেট সুজনের হাতে তুলে দেয়। বন্ধুরা ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। সবাই এখানে এসেছেই এই উদ্দেশ্যে। সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে প্রস্তাবিত’ কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র’ স্থাপনের আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য সহমত প্রদর্শনে ওরাও আগামীকাল সবার সাথে একত্রিত হতে যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে ওদের এই পাঁচ বন্ধুর ভিতরে রাজনৈতিক মতাদর্শের কিছু ভিন্নতা থাকলেও দেশেরও জনগনের ভালো’র প্রশ্নে ওরা সবসময়ই এক। সেই ছাত্রজীবনে পরিচয়ের প্রথম থেকেই। অবশ্য রশীদের সাথে পরবর্তিতে অন্যভাবে পরিচয়। তা সত্ত্বেও রশীদ পরিচয়ের পর থেকে নিজের নিজস্বতা দিয়ে ওদের অনেক কাছে আসতে পেরেছে।
প্রথমবার ওরা এক হয়েছিল কানসাট ট্রাজেডী’র সময়। সেবারও এই গাজীপুর থেকেই ওরা ৫ জন একটি নসিমন নিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন সহ কানসাট অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল। চান্দোরার কাছে এসে সরকারী ছাত্র সংগঠন পুলিশের ছত্রছায়ায় ওদেরকে বাঁধা দেয়। ব্যানার-ফেস্টুন ছিড়ে ফেলে। নসিমনের ড্রাইভারসহ ওদেরকে বেদম পেটানো হয়। রুনাধও বাদ দেয়নি। ড্রাইভারকে অবৈধ নসিমন নিয়ে হাইওয়েতে বের হবার অপরাধে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায় পুলিশ। অথচ প্রতিদিনই রাস্তায় সেগুলো চলছে। টাকা খাওয়া পুলিশের নজরে সেগুলো পড়ে না।
ওদের ৩ জন আওয়ামী লীগ ও ২ জন বিএনপি’র সমর্থন করে। কিন্তু সেই বিএনপি আমলেও তারা এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার নিন্দা জানাতে পিছপা হয়নি। দল এবং রাজনীতি থেকে মানবতা তখন প্রকট হয়েছিল ওদের কাছে।
এবারও সুন্দরবন নিয়ে তেমনি হতে চলেছে। আওয়ামী লীগ করলেও এই তিনজন দলকে দেশের উপরে স্থান দেয় নি।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার আহ্বান জানিয়ে আসছে টিআইবি’র সাথে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং সেভ দ্য সুন্দরবন। এদের সমন্বিত আন্দোলনের সাথে ওরা ৫ বন্ধুও নিজেদের অবস্থান থেকে এই আন্দোলনে শরিক থাকতে চায়। এর আগেও এই সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সেমিনার এবং সংবাদ সম্মেলনে ওরা অংশগ্রহন করেছে।
একবারতো সুজনের সাথে এক কট্টর আওয়ামী সমর্থক বন্ধুর তুমুল লেগে গেল। সুজন তাকে কোনোমতেই বুঝাতেই পারলোনা যে, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী কেবলমাত্র শিল্প এলাকা, শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা অথবা ফাঁকা এলাকায় বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। আর সত্য গোপন করে প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা (আইইই)-এর ভিত্তিতে দেয়া অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিল... জমি অধিগ্রহন ও ভুমি উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম স্থগিত... বিপিডিবি ও এনটিপিসি এর ভিতরকার ২৯ জানুয়ারি’১২ এর চুক্তি আমজনতার সামনে প্রকাশ ... এই দাবীগুলোকে নিয়েই সবাই এক হবে আগামীকাল। সরকার দাবি উত্থাপনের পর এখন পর্যন্ত চুক্তির দলিল জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি...
খাবার টেবিলে ৪ বন্ধু অপেক্ষা করছে ওদের আরো এক বন্ধুর জন্য...
চারজন সাদা-কালোয় মেশানো মানুষ একজন রংপুরের ‘মফিজ’ এর জন্য অপেক্ষারত... যে কিনা এক অখ্যাত বাদামওয়ালার রক্তে রঞ্জিত হয়ে নিজের সকল টাকাপয়সা সেই ছেলেটির চিকিৎসায় ব্যয় করে হেঁটে হেঁটে আসছে ওদের দিকেই...
কালো মানুষদের ভিড়ে কিছু সাদা মনের মানুষ এভাবে যুগে যুগে হেঁটে আসতেই থাকবে...
আমাদের দিকে...
আমাদের ভালোর জন্য... নিজেদেরকে ওরা উতসর্গ করবে।
বাংলাদেশ অপেক্ষায়... কয়েকজন সাদা মানুষের আসার...
আপনার আমার আশেপাশেই আছে ওরা।
কেবল চিনে নেয়াটাই বাকী!
এখন পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, এই পাঁচজন কে কীভাবে সাদা মনের মানুষ বলা যায়? এদেরকেই কেন গল্পে তুলে ধরা হল? এরা নিজেরাও তো মনের গহীনে অনেক অন্ধকারকে বহন করে চলেছে?
হ্যা, এরা কেউই সাদা নয়। তবে সাদা হবার আন্দোলনে নেমেছে। এরা নিজেদের কালো অধ্যায়গুলোকে চিনে নিয়েছে, সেগুলোকে কিছু সাদা গুণ দিয়ে মুছে ফেলতে চাচ্ছে।
খালিদ- একজন নেশাখোর যুবক হিসেবে পরিবার এবং সমাজের কাছে পরিচিত। তবে সে এই খারাপ গুনটিকে উপলব্ধি করেছে, ছেড়ে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে নিরন্তর। সে তার ঠোঙ্গা বানানোর প্রোজেক্টে বেছে বেছে এমন সব প্রতিবন্ধি মানুষদেরকে চাকরি দিয়েছে, যাদেরকে কেউ কখনো কাজ দিবে না। ওর প্রতিষ্ঠানের জনবলের ৫০% এরকম প্রতিবন্ধি। এদের জন্য সপ্তাহে দু'দিন সে বন্ধ রাখে তার প্রতিষ্ঠান। সবাই-ই এই দু'দিন বন্ধের সুযোগটি পায়। খালিদ অবসরে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় এরকম আরো প্রতিবন্ধিদের খুঁজে পেতে। কিছু ভিক্ষুকদেরকেও সে তার প্রোজেক্টে কাজে লাগিয়েছে, যারা নিজেদের সেই ঘৃণিত পেশা ছেড়ে এখন কাজ করে প্রতিষ্ঠিত।
রুনা- এক সময় নিজের স্বামীর অবহেলায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই নারী এক সময় বিবাহ পরবর্তী অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে ফিরে আসে সে। ছিন্নমূল পথ শিশুদের জন্য একটি স্কুল খুলেছে সে। ওর সাথে আরো কয়েকজন সমমনা মহিলা এই কাজে এগিয়ে এসেছে। এরা পথ শিশুদেরকে খুঁজে খুঁজে এখানে নিয়ে আসে। ওদের জণ্য সরকার যে ন্যুনতম মৌলিক চাহিদাগুলো পুরণ করছে না, সেগুলোর যতটুকু পারে, করার চেষ্টা করে।
হেলাল- এই মানুষটি আদালতপাড়ায় নিজের পরিচিত গন্ডীতে চরম টাকার ক্ষাক্কস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সে গোপনে গোপনে এমন গরীবদেরকে আইনি সহায়তা দেয়, একমাত্র সেই সহায়তা প্রাপ্ত ব্যক্তিটি ছাড়া এ খবর একমাত্র আমিই জানি। আজ আপনারাও জানলেন। সক্ষম মক্কেলদের কাছ থেকে যেভাবে যতটুকু পারা যায় টাকা খালিদ নিয়ে নেয়। কিন্তু টাকার অভাবে আদালতপাড়ায় এমন অনেক ছিন্নমূল মানুষ এসে নিঃশব্দে ইটপাথরের তৈরী বিল্ডিঙগুলোর পাদদেশে নিজেদের মাথা ঠুকছে- এদের সেই শব্দহীন আর্তনাদ কেবল খালিদের কানেই ধরা পড়ে। সে আরো নিঃশব্দে অন্য উকিল দ্বারা নিজে খরচাপাতি দিয়ে তাঁদের সাহায্য করে থাকে। এভাবেই নিজের ভিতরে এক ডাবল রোল প্লে করে চলেছে হেলাল।
সুজন- একটি প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো একটি পদে জব করার সুবাদে বিভিন্ন গরীব মানুষকে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জন বেকার মানুষকে সে কাজে লাগাতে পেরেছে। যারা আগে কর্মহীন ছিল। এদের সবাইকে নিজের কারখানায় নয়, পরিচিত বিভিন্ন কারখানায় অনেক বলে কয়ে ঢুকিয়েছে। এই দেড়শ' জন মানুষ মানে দেড়শ'টি পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্তত তিনবেলা আহার আল্লাহপাক সুজনকে উছিলা করে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন (যদিও আল্লাহ পাকের এই রিজিক পাঠাতে কোনো উছিলার প্রয়োজন হয় না)। তবে এই কাজটি সুজন একেবারে নিঃস্বার্থভাবে করে থাকে। না হলে এই যুগে কাউকে চাক্রিতে ঢুকানোর সময় কিছু না কিছু দিতেই হয়- তা সে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতেই হোক না কেন।
রশিদ- এর ব্যাপারে আর বলার কিছু রয়েছে কি? জন্ম থেকে অভাবের সাথে সংগ্রাম করে সে বড় হয়েছে। এক সময় খারাপ পথে চলে গিয়েছে। সুজন নামের মানুষটি ওকে সোজা পথে নিয়ে আসে। তবে কালো পথে থেকে থেকে ওর হৃদয়টি একেবারে কালো হয়ে যায়নি। সেখানে মাঝে মাঝে কিছু শ্বেত-শুভ্র শুভবুদ্ধির ঝিলিক উদয় হতো। আর এই আলোর সম্মোহনে সে এমন এমন কিছু কাজ করত যা মানুষের উপকারেই লাগে। সুজনের চোখে এভাবেই সে একদিন পড়ে এবং সাদা মনের মানুষ হবার আন্দোলন করছে এমন একটি দলের সদস্য হয়।
[কয়েকজন সাদা মানুষ পর্ব এখানে শেষ । তবে এটা ওদের পরিচয় পর্ব শেষ হল। দেশের বিভিন্ন ক্রান্তি লগ্নে ওরা বার বার ফিরে আসবে আমাদের মাঝে। আর আমি বেঁচে থাকলে সেগুলো সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আমার কালো হৃদয় ওদের সাদা হতে চাওয়া মন নিয়ে লিখে লিখে যদি একটু সাদা করা যায়।]
বিষয়: সাহিত্য
৯৫০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাদা মনের অসাধারণ একজন মামুন কে অভিনন্দন জানাই অন্তর থেকেই.......।
অনেক ধন্যবাদ আপনার নান্দনিক মন্তব্যের জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
যার যার লেখার ধাঁচ আলাদা, আমার ভালোলাগার অনুভূতিও এক একরকম। তাই আপনার মন্তব্য-সেটিও তো লেখাই, আমার কাছে নান্দনিক মনে হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আপনার লেখার মান আপনি কীভাবে বুঝবেন? পাঠক আপনাকে মুল্যায়ণ করবে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনেক শুভেচ্ছা তোমার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সাদা মনের মানুষ কারো দালালি করবে না।
ধন্যবাদ আপনাদের।
আপনি নিজে যদি সাদা মনের মানুষ হন, তবে আমাকে চিনতে পারবেন, আমি কালো মনের না সাদা মনের।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন